ট্যাটু এবং ক্যান্সার সম্পর্কে আপনার কি জানা উচিত?

You are currently viewing ট্যাটু এবং ক্যান্সার সম্পর্কে আপনার কি জানা উচিত?

ট্যাটু বহুদিন ধরেই এক ধরনের নিজেকে প্রকাশ করার মাধ্যম এবং সামাজিক পরিচয়ের অংশ হিসেবে দেখা হয়। অনেকেই তাদের শরীরকে বিভিন্ন অর্থপূর্ণ চিহ্ন বা শিল্পকর্ম দিয়ে সাজিয়ে তোলেন, যা তাদের ব্যক্তিত্ব বা জীবনের গল্পকে তুলে ধরে। তবে সময়ের সাথে সাথে ট্যাটু আর ক্যান্সারের মধ্যে সম্ভাব্য সম্পর্ক নিয়ে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে। এই বিষয়টি অনেক আলোচনার জন্ম দিয়েছে এবং ট্যাটু করানো কি আদৌ নিরাপদ, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

ট্যাটুর ইতিহাস

ট্যাটু বা উল্কি শরীরের প্রাচীন এক শিল্প, যার একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে—যা হাজার হাজার বছর ধরে নানা সমাজ ও সংস্কৃতির মধ্যে গড়ে উঠেছে।এই শরীর আঁকার চল মানব সভ্যতার শুরু থেকেই ছিল, এমনকি নিওলিথিক যুগেও এর অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়।উল্কির এই ঐতিহাসিক যাত্রা কেবল সাজসজ্জার জন্য নয়, এটি বিভিন্ন সমাজের সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও সৃজনশীল পরিবর্তনের প্রতিফলনও বহন করে।

“ট্যাটু” শব্দটি এসেছে পলিনেশিয়ান শব্দ “টাটাউ” থেকে, যার মানে হলো—কোনো কিছু পরীক্ষা করা বা ছাপ ফেলা।অনেকেই মনে করেন, ট্যাটুর শুরু হয়েছিল পলিনেশিয়া অঞ্চল থেকেই। এই এলাকার আদিবাসীরা ট্যাটুকে শুধু সাজসজ্জা নয়, বরং একধরনের গভীর মানসিক ও সামাজিক বার্তা হিসেবেই ব্যবহার করতেন। সামোয়াতে একে বলা হতো “টাটাউ” আর তাহিতিতে “তাতু”। এই ট্যাটুগুলো ছিল নিজেকে প্রকাশ করার একটা উপায়—যেখানে একজনের মর্যাদা, ব্যক্তিত্ব আর সমাজে তার অবস্থান ফুটে উঠতো।

প্রাচীন মিশরে ট্যাটু ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ—এটা শুধু সাজ নয়, বরং এর সামাজিক এবং ধর্মীয় মানেও ছিল গভীর।

প্রত্নতত্ত্ববিদরা এমন অনেক মমি খুঁজে পেয়েছেন, যাদের শরীরে ট্যাটু ছিল। এই মমিগুলোর বয়স প্রায় ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দেরও আগের। ট্যাটুগুলোতে এমন চিহ্ন থাকত যেগুলো পরিপক্বতা, সুরক্ষা বা আত্মিক বিশ্বাসের প্রতীক ছিল।

আর পুরোনো চীনে ট্যাটুকে ধরা হতো একধরনের রহস্যময় শিল্প হিসেবে। অনেকেই বিশ্বাস করতেন, ট্যাটু আত্মাকে রক্ষা করে এবং ভিতরের শক্তিকে জাগিয়ে তোলে।

জাপানে ট্যাটুর যে শিল্প, যেটিকে বলা হয় “ইরেজুমি”, তার রয়েছে এক দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ ইতিহাস।

শুরুর দিকে এই ট্যাটুগুলো ছিল শাস্তির চিহ্ন—যারা আইন ভাঙত, তাদের শরীরে ট্যাটু দিয়ে চিহ্নিত করা হতো। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ধারণা অনেক বদলেছে।এখন ইরেজুমি শুধু সাজসজ্জা নয়, বরং শক্তি, ধৈর্য আর আর্থিক সমৃদ্ধির প্রতীক হয়ে উঠেছে।ইরেজুমি শিল্পীরা এক বিশেষ ধরণের শৈলী তৈরি করেছেন—যেখানে জাপানি পুরাণে থাকা ড্রাগন, কোই মাছ, আর চেরি ফুলের মতো নানা প্রতীক ফুটে ওঠে, দারুণ রঙ আর নকশায়। এই শিল্পে থাকে গভীর মানে আর এক অনন্য সৌন্দর্য।

পশ্চিমা দুনিয়ায়, প্রাচীন গ্রীক ও রোমান সভ্যতায় ট্যাটু ছিল খুবই প্রচলিত। তখন এটা ছিল পরিচয়, মর্যাদা বা দাসত্বের চিহ্ন হিসেবেও ব্যবহৃত।কিন্তু পরে, খ্রিস্টধর্ম ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ট্যাটুর গুরুত্ব কমে যেতে থাকে। কারণ, অনেকেই ভাবত ট্যাটু নাকি ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরুদ্ধে, বা অজ্ঞেয়বাদী ধ্যানধারণার সঙ্গে জড়িত।তবে অষ্টাদশ শতকের দিকে আবার ট্যাটু পশ্চিমে ফিরে আসতে শুরু করে। দুঃসাহসিক অভিযাত্রী আর নাবিকরা বিদেশ থেকে ট্যাটুর এই রীতি নিয়ে ফিরত, আর ধীরে ধীরে তা আবার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।এইভাবেই ট্যাটু ফিরে আসে পশ্চিমের সমাজে, এক নতুন রূপে।

উনবিংশ শতকে (১৮০০ সালের দিকে) ট্যাটু আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং অনেক সময় সার্কাস বা মেলায় ট্যাটু করা মানুষদের আলাদা আকর্ষণ হিসেবে দেখানো হতো।তবে আসল পরিবর্তন আসে বিশ শতকে। এই সময়ে ট্যাটু ধীরে ধীরে মূলধারার সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠে।বিখ্যাত সেলিব্রেটি বা তারকারা যখন ট্যাটু করা শুরু করেন, তখন সাধারণ মানুষও এটাকে একটা স্টাইল বা নিজের পরিচয় প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে দেখতে শুরু করে।এছাড়াও, আধুনিক ট্যাটু পার্লারগুলো গড়ে উঠতে শুরু করে, যেখানে পেশাদার শিল্পীরা নিরাপদভাবে ট্যাটু করতেন। এতে ট্যাটুর জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে যায়, আর সমাজেও ট্যাটু ধীরে ধীরে স্বীকৃতি পেতে শুরু করে।

অনেক বছর ধরে ট্যাটু ধীরে ধীরে সমাজের সীমা ছাড়িয়ে এখন এক বিশ্বজোড়া পরিচিত ও জনপ্রিয় শিল্প হয়ে উঠেছে।নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব আর মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের ফলে এই উল্কি শিল্প আরও রঙিন ও বৈচিত্র্যময় হয়েছে। এখন ট্যাটুর অনেক রকম স্টাইল ও পদ্ধতি সহজেই পাওয়া যায়।পুরনো দিনের ঐতিহ্যবাহী নকশা থেকে শুরু করে আধুনিক, ঝামেলাবিহীন ডিজাইন—সবকিছুই আজ মানুষের হাতে।নিজের পরিচয়, অনুভূতি বা গল্প শরীরের মধ্যে ফুটিয়ে তোলার জন্য ট্যাটু এখন এক অসাধারণ মাধ্যম, আর পছন্দের জায়গায় এর কোনো ঘাটতি নেই।

ট্যাটুর ইতিহাস হলো নিজের কথা বলার, ব্যক্তিত্ব প্রকাশের আর সামাজিক মর্যাদা দেখানোর জন্য মানুষের এক অনড় আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন।

পলিনেশিয়ায় এক সময় এটা ছিল একটা পবিত্র রীতি, আর পশ্চিমা দেশে একসময় এটা বিদ্রোহ বা অবাধ্যতার চিহ্ন হিসেবে দেখা হতো।

কিন্তু আজ ট্যাটু এমন এক শিল্পে পরিণত হয়েছে, যা সারা বিশ্বের মানুষকে মুগ্ধ করে এবং অনুপ্রাণিত করে।

এই আলোচনা আমাদের ট্যাটু আর ক্যান্সারের মধ্যে সম্পর্ক বুঝতে সাহায্য করবে, ট্যাটু নিয়ে প্রচলিত ভুল ধারনাগুলো দূর করবে এবং ট্যাটু নিয়ে গভীর ভাবনায় নিয়ে যাবে।

ট্যাটু প্রক্রিয়া:

ট্যাটু করার জন্য সূঁচ ব্যবহার করে ত্বকের ডার্মাল স্তরে রঙ ঢুকানো হয়। এই পদ্ধতিতে ত্বকের ওপর এমন এক স্থায়ী নকশা বা ছবি তৈরি হয় যা সহজে মুছে যায় না। ট্যাটুর ভালো অবস্থান অনেকটাই নির্ভর করে ব্যবহৃত পরিষ্কার ও নির্জন যন্ত্রপাতি, ভালো মানের কালি এবং কাজ করার সময় সঠিক পরিচ্ছন্নতা মেনে চলার ওপর।

কালির ব্যবহার আর উদ্বেগ:

ট্যাটু এবং ক্যান্সারের ক্ষেত্রে উদ্বেগের একটি ক্ষেত্র ট্যাটু কালির কাঠামোর চারপাশে ঘোরে। প্রচলিত ট্যাটু কালিতে সীসা, পারদ এবং ক্যাডমিয়ামের মতো ওজনদার ধাতু সহ বিভিন্ন পদার্থ থাকে। যদিও এই উপাদানগুলি দীর্ঘস্থায়ী সুস্থতার প্রভাব সম্পর্কে উদ্বেগ বাড়াতে পারে, ট্যাটু কালি এবং ক্যান্সারের মধ্যে সংযোগ বিশ্লেষণ করা গবেষণাগুলি অনিশ্চিত।

ট্যাটু এবং ক্যান্সার নিয়ে গবেষণা:

জানুয়ারি ২০২২ পর্যন্ত আমার শেষ তথ্য আপডেটে দেখা গেছে, ট্যাটু আর ক্যান্সারের মধ্যে সরাসরি কোনো স্পষ্ট সম্পর্ক পাওয়া যায়নি। কিছু গবেষণায় বলা হয়েছে যে কিছু ট্যাটু রঙ লিম্ফ নোডে (লিম্ফ হাব) চলে যেতে পারে, কিন্তু এই স্থানান্তরের শরীরের উপরে প্রভাব এখনো পরিষ্কার নয়।

মনে রাখা দরকার, এই বিষয় নিয়ে গবেষণা এখনও চলছে এবং আমার শেষ আপডেটের পর থেকে নতুন কিছু তথ্য আসতে পারে।

ত্বকের ক্যান্সার আর ট্যাটু:

স্কিন ক্যান্সার নিয়ে চিন্তা থাকে অনেকের, বিশেষ করে যারা ট্যাটু করিয়েছেন বা করতে চাচ্ছেন। কারণ ট্যাটু করার সময় কালি সরাসরি ত্বকে প্রবেশ করে।

তবে ভাল মানের ট্যাটু শিল্পীরা পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকেন এবং সংক্রমণের ঝুঁকি কমানোর জন্য কঠোর নিয়ম মেনে চলেন।

যদি ট্যাটুর আকার, রঙ বা আকৃতিতে কোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখা যায়, তাহলে সেটা ত্বকের ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে বলে দ্রুত পরীক্ষা করানো উচিত।

অতিরিক্ত সংবেদনশীল প্রতিক্রিয়া এবং জ্বালা:

কিছু মানুষের ট্যাটু করার পর অতিসংবেদনশীলতা বা জ্বালাপোড়া হতে পারে। যদিও এসব সমস্যা সাধারণত ক্যান্সারের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, তবু ভালো মানের কালি ব্যবহার এবং ট্যাটুর পর সঠিক যত্ন নেওয়া খুবই জরুরি।

অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা সাধারণত তখন হয় যখন কেউ ত্বকে স্পর্শকাতর রঙ ব্যবহার করে বা ট্যাটু করানোর সময় কারিগর ঠিকমতো পরিচ্ছন্নতা না মেনে নোংরা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে।

ট্যাটু মোছার প্রক্রিয়া আর ক্যান্সারের ঝুঁকি:

ট্যাটু মুছে ফেলার পদ্ধতিগুলোর মধ্যে যেমন লেজার ব্যবহারের মতো প্রযুক্তি, ত্বকে রঙের পার্থক্য তৈরি করতে পারে—এ নিয়ে কিছু উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। যদিও গবেষণা চলছে, এখনো এমন কোনো শক্তিশালী প্রমাণ নেই যা দেখায় যে ট্যাটু মুছে ফেলা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। তা সত্ত্বেও, যারা এই প্রক্রিয়া বিবেচনা করছেন, তাদের উচিত অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করা এবং নির্ভরযোগ্য আফটার কেয়ার পদ্ধতি অনুসরণ করা।

মিথ্যা ধারণা আর সত্যি কারণ:

কিছু ভুল ধারণা আছে ট্যাটু আর ক্যান্সারের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে। অনেকেই ভাবে ট্যাটু করলে সরাসরি ক্যান্সার হয়, কিন্তু এখনো পর্যন্ত এই কথার কোনো শক্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি।আর ট্যাটু করা নিয়ে এক্স-রে বা রিভারবারেশন ইমেজিং এর কারণে ক্যান্সারের ঝুঁকি নিয়ে যে ভয় আছে, সেটা বেশিরভাগ সময় অতিরঞ্জিত। অধিকাংশ সময় ট্যাটু থাকলেও এক্স-রে পরীক্ষা করানোতে কোনো বড় ঝুঁকি হয় না, যদি সুস্থতার নিয়ম মেনে পরীক্ষা করা হয়।

উপসংহার

সব মিলিয়ে, ট্যাটু আর ক্যান্সারের মধ্যে সম্পর্কটা খুব জটিল এবং এখনও গবেষণার বিষয়। কিছু উদ্বেগ থাকলেও বেশির ভাগ প্রমাণ বলে ট্যাটু, যদি ভালো ও নিরাপদভাবে অভিজ্ঞ কারিগর দ্বারা করা হয়, তাহলে সেটা কোনো বড় ক্যান্সারের ঝুঁকি সৃষ্টি করে না।

মানুষের উচিত ভালো মানের অনুমোদিত ট্যাটু বিশেষজ্ঞ বাছাই করা, পরে ঠিকমত যত্ন নেওয়া এবং ট্যাটুতে কোনো অস্বাভাবিকতা বা সমস্যা হলে দ্রুত পরীক্ষা করানো।

আমরা বলতে পারি, ট্যাটুর নিরাপত্তা নিয়ে কাজ চলছে, ভালো অভ্যাস মানা হচ্ছে, আর কারিগররা এই পুরানো শিল্পকে সম্মান দিয়ে বজায় রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে।

Disclaimer:

This information on this article is not intended to be a substitute for professional medical advice, diagnosis, treatment, or standard medicines. All content on this site contained through this Website is for general information purposes only.