ক্যান্সারের উপসর্গগুলো কি আমরা উপেক্ষা করতে পারি না?

You are currently viewing ক্যান্সারের উপসর্গগুলো কি আমরা উপেক্ষা করতে পারি না?

ক্যান্সার একটা জটিল আর ভয়ানক রোগ, যা আমাদের শরীরের অস্বাভাবিক কোষের নিয়ন্ত্রণহীন বৃদ্ধির কারণে হয়। শুরুতে এটা চিহ্নিত করতে পারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তাতে চিকিৎসার সফলতার সম্ভাবনা অনেক বাড়ে। ক্যান্সার হলে শরীরে নানা রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেগুলোকে বোঝা এবং নজর দেওয়া দরকার। অনেক সময় ছোট ছোট লক্ষণগুলোকে আমরা উপেক্ষা করি, কিন্তু সেগুলোই ক্যান্সারের আগাম সতর্ক সংকেত হতে পারে।

এই লেখায় ক্যান্সারের প্রধান প্রধান লক্ষণগুলো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে, যেগুলো জানা খুবই জরুরি যেন প্রয়োজনীয় সময়ে সঠিক চিকিৎসা নেওয়া যায়।

অকারণে ওজন কমে যাওয়া:

ক্যান্সারের এক অজানা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সংকেত হলো হঠাৎ করে ওজন কমে যাওয়া, বিশেষ করে যদি আপনি ডায়েট না করছেন বা বেশি শারীরিক পরিশ্রমও করছেন না। কখনো কখনো ক্যান্সারের কোষ শরীর থেকে অতিরিক্ত শক্তি নিতে থাকে, যার ফলে শরীর স্বাভাবিকের থেকে দ্রুত ওজন হারাতে পারে। কয়েক মাসের মধ্যে যদি আপনার ওজন 5 শতাংশ বা তার বেশি কমে যায়, তাহলে এটা অবশ্যই চিন্তার বিষয় এবং সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত।

নির্ধারিত দুর্বলতা:

আমাদের ব্যস্ত জীবনে দুর্বলতা অনেক সময় স্বাভাবিক মনে হলেও, কখনও কখনও এটি ক্যান্সারের মতো গুরুতর অসুস্থতার একটি সংকেতও হতে পারে। ক্যান্সার-সম্পর্কিত দুর্বলতা সাধারণ বিশ্রামে ঠিকমতো কমে না এবং দৈনন্দিন কাজ বা হাঁটাচলাতেও বাধা দেয়। যদি আপনি দীর্ঘ সময় ধরে এমন এক ধরনের ক্লান্তি অনুভব করেন যা বিশ্রাম করেও দূর হচ্ছে না, তাহলে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

ত্বকের পরিবর্তন:

ত্বকের যে কোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন কখনও কখনও ক্যান্সারের প্রথম চিহ্ন হতে পারে। যেমন মোলের আকৃতি, আকার বা রঙ বদলে গেলে কিংবা নতুন কোন দাগ বা গঠনের দেখা দিলে সতর্ক হওয়া উচিত। ত্বক যদি হলদে বা নোংরা রঙ ধারণ করে, তা লিভারের সমস্যার লক্ষণ হতে পারে, যা লিভার ক্যান্সারের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে। এছাড়াও, অজানা ফুসকুড়ি, অতিরিক্ত চুল ওঠা বা ত্বকে ঝিঁঝিঁ পোকা অনুভব হওয়া শরীরের ভিতর কোনো সমস্যা থাকতে পারে, যা সহজেই এড়িয়ে যাওয়া  উচিত নয়।

শরীর কষ্ট বা ব্যথা:

দীর্ঘ সময় ধরে অবিরত যন্ত্রণার অনুভূতি কখনও কখনও ক্যান্সারের সতর্ক সংকেত হতে পারে। যদিও যন্ত্রণা অনেক কারণে হতে পারে, তবে এমন যন্ত্রণা যা সাধারণ ওষুধে আরাম পায় না, সেটি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। হাড়ের যন্ত্রণা, তীব্র মাথাব্যথা বা পেটে ব্যথা যা দীর্ঘস্থায়ী হয়, সেগুলোকে উপেক্ষা না করে একজন চিকিৎসকের কাছ থেকে সম্পূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো উচিত, যাতে কোনো গুরুতর সমস্যার পূর্বাভাস ধরা পড়ে।

অন্ত্র বা মূত্রাশয় প্রবণতা পরিবর্তন:

পায়ূকার্যে বা প্রস্রাবের অভ্যাসে হঠাৎ বদল অনেক সময় কোলোরেক্টাল, মূত্রাশয় বা প্রোস্টেট ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। বারবার প্রস্রাব আটকে যাওয়া, পায়খানায় রক্ত থাকা, বা প্রস্রাবের আওয়াজে পরিবর্তন হলে সেটাকে অবহেলা করা ঠিক নয়। এসব লক্ষণ কোনো বড় সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে, তাই দ্রুত ডাক্তারের কাছে যাওয়া দরকার।

গলায় সমস্যা:

গার্গল কষ্ট হওয়া, যা ডিসফ্যাজিয়া নামে পরিচিত, অনেক সময় গলা বা খাদ্যনালির টিউমারের লক্ষণ হতে পারে। যখন গলানোর সময় ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভব করেন, বা গলায় খাবার আটকে থাকার মত লাগায়, তখন দ্রুত একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করানো খুবই জরুরি। এ ধরনের সমস্যা উপেক্ষা করলে বড় ধরনের স্বাস্থ্য জটিলতা হতে পারে, তাই সময়মতো চিকিৎসা নেওয়া আবশ্যক।

অনবরত  হাঁচি বা কাশি:

দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকা একটানা কাশি, যা দুই সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয়, তা ফুসফুস বা গলার ক্যান্সারের একটা সতর্ক সংকেত হতে পারে। যদিও সাধারণ ঠাণ্ডা বা শ্বাসনালীর সমস্যা থেকেও কাশি হতে পারে এবং অনেক সময় সেটা নিজেই ভালো হয়ে যায়, কিন্তু যদি কাশির সঙ্গে রক্ত মিশে আসে বা শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, তখন অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এ ধরনের লক্ষণ অবহেলা করলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায়, তাই দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ জরুরি।

স্তনের টিস্যুর পরিবর্তন:

স্তনের পরিবর্তনগুলো স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে, যা যেকোনো মানুষের জীবনে দেখা দিতে পারে। নতুন কোনো গাঁট, স্তনের আকার বা আকৃতির পরিবর্তন, অ্যারিওলা থেকে তরল নির্গমন, অথবা ত্বকে লালচে ভাব বা গর্তের মত ছিদ্র দেখা দিলে দ্রুত একজন ডাক্তারের কাছে যাওয়া জরুরি। নিয়মিত নিজেই স্তন পরীক্ষা করা এবং ম্যামোগ্রাম করানো সময়মত ক্যান্সার ধরা পড়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

পরিশ্রমী অম্বল বা খাওয়ার সমস্যা:

লম্বা সময় ধরে অম্বল বা খেতে কষ্ট হওয়া পেট বা খাদ্যনালীর ক্যান্সারের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। এমনকি ছোটখাটো খাবারের পরও যদি আপনি নিয়মিত বুকে চাপ, ফুলে ওঠা বা ভর্তি হওয়ার অনুভূতি পান, তাহলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। এই ধরনের সমস্যা যাতে বেশি বড় না হয়, সে জন্য সময় মতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

লিম্ফ হাব পরিবর্তন:

লিম্ফ গাঁট শরীরের সুরক্ষার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ, আর ক্যান্সার ছড়ালে এই গাঁটগুলো প্রায়ই ফুলে যায় বা কঠিন হয়ে যায়। যদি কোনো লিম্ফ গাঁট অনেক দিন ধরে বড় থাকে বা স্পর্শ করলে শক্ত লাগে, তবে এটা শরীরের ভিতরে ক্যান্সারের সংকেত হতে পারে। ঘাড়, বগল বা নিতম্বের কাছে লিম্ফ গাঁটের পরিবর্তন লক্ষ্য করলে দ্রুত ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত।

ক্যান্সারের কিছু সাধারণ চিকিৎসা কি কি?

ক্যান্সার মানেই শরীরের কোষগুলোর অস্বাভাবিক ও নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে বেড়ে ওঠা। এটা এমন একটা জটিল অসুখ, যা সারা বিশ্বে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। ক্যান্সার প্রতিরোধ ও চিকিৎসার জন্য অনেক রকম চেষ্টা-চরিত্র চলছে, আর সেই কারণেই চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর থেরাপি নিয়ে নিয়মিত গবেষণা হয়।

ক্যান্সার চিকিৎসায় সময়ের সঙ্গে অনেক উন্নতি হয়েছে। আগে যেখানে শুধু অপারেশন বা কেমোথেরাপি ব্যবহার হতো, এখন ইমিউনোথেরাপি ও টার্গেটেড থেরাপির মতো আধুনিক পদ্ধতিও ব্যবহার হচ্ছে।

চিকিৎসা বা অপারেশন অনেক সময় ক্যান্সার থেরাপির প্রথম ধাপ। যদি ক্যান্সার শরীরের অন্য কোথাও ছড়িয়ে না পড়ে, তখন অপারেশনের মাধ্যমে ক্যান্সার কোষ বা আক্রান্ত অংশ কেটে ফেলা হয়। যদি ক্যান্সারটি আগেই ধরা পড়ে, তাহলে অপারেশন অনেক সময়ই সফল হয়। তবে অপারেশন একা নয়, অনেক সময় কেমো বা রেডিয়েশন থেরাপির সঙ্গে মিলে পুরো চিকিৎসা পরিকল্পনা তৈরি করা হয়।

কেমোথেরাপি হলো এমন এক ধরনের ওষুধের চিকিৎসা, যা ক্যান্সার কোষ মেরে ফেলে বা তাদের বেড়ে ওঠা বন্ধ করে দেয়। এই ওষুধ মুখে খাওয়া যায় বা শিরায় দেওয়া হয়। তবে এই ওষুধ শুধু ক্যান্সার কোষই নয়, শরীরের অন্য ভালো কোষকেও ক্ষতি করতে পারে। তাই অনেক সময় বমি, চুল পড়ে যাওয়া, আর খুব ক্লান্তি লাগে।

রেডিয়েশন থেরাপি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা পদ্ধতি, যেখানে উচ্চ-ক্ষমতার রশ্মি ব্যবহার করে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করা হয়। কখনো বাইরের যন্ত্র থেকে এই রশ্মি দেওয়া হয়, আবার কখনো তেজস্ক্রিয় পদার্থ সরাসরি শরীরের ভেতরে প্রয়োগ করা হয়। রেডিয়েশন থেরাপিও অপারেশন বা কেমোর সঙ্গে মিলিয়ে ব্যবহার হয়।

ইদানীং ইমিউনোথেরাপি অনেক আশার আলো দেখাচ্ছে। এই চিকিৎসায় শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে এমনভাবে জাগিয়ে তোলা হয় যাতে সেটা ক্যান্সার কোষকে চিনে ফেলে এবং ধ্বংস করে দেয়। এখানে বিশেষ ধরণের ওষুধ যেমন মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি বা টার্গেটেড ইনহিবিটর ব্যবহার হয়। এতে শরীরের ভালো কোষের ক্ষতি কম হয় এবং ক্যান্সার কোষের ওপর নির্দিষ্টভাবে কাজ করা যায়।

টার্গেটেড থেরাপি মানে এমন ওষুধ দেওয়া, যা ক্যান্সার কোষ বেড়ে ওঠার জন্য দায়ী নির্দিষ্ট প্রোটিন বা রাস্তা বন্ধ করে দেয়। কেমোথেরাপির মতো সবার ওপর প্রভাব ফেলে না, বরং নির্দিষ্ট কোষে কাজ করে। এতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও কম হয় এবং চিকিৎসার সাফল্যের সম্ভাবনাও বেশি থাকে।

এছাড়াও, এখন কাস্টমাইজড চিকিৎসার ধারাও বাড়ছে। মানে, একেকজন রোগীর ক্যান্সার কোষের জেনেটিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। কার শরীরে কী ধরনের রূপান্তর হয়েছে সেটা বুঝে, সেই অনুযায়ী ওষুধ বা থেরাপি দেওয়া হয়, যাতে ফল ভালো হয়।

তবে যত উন্নত চিকিৎসাই আসুক, কিছু চ্যালেঞ্জ থেকেই যায়। যেমন ক্যান্সার কোষের প্রকৃতি বদলানো, দেরিতে ধরা পড়া, অথবা সব চিকিৎসায় কাজ না করা—এই সব বিষয় এখনো চিন্তার কারণ। তাই গবেষণা এখনো চলছে যাতে আরও নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার হয়, পুরনো পদ্ধতিগুলো আরও উন্নত করা যায়, আর ক্যান্সার যেন আগেই ধরা পড়ে।

উপসংহার

উপরে যেসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে, সেগুলো শুনে ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এসব লক্ষণ সবসময় ক্যান্সারের কারণে হয় না। অনেক সময় সাধারণ অসুখেও এমন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।

তবে একটা বিষয় খুবই জরুরি — ক্যান্সার যদি প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়ে এবং সময়মতো চিকিৎসা শুরু হয়, তাহলে ভালোভাবে সুস্থ্য  হয়ে ওঠার সম্ভাবনাও অনেক বেড়ে যায়।

যদি আপনার শরীরে কোনো লক্ষণ বারবার দেখা দেয় বা কোনো কারণ ছাড়াই অস্বাভাবিক কিছু অনুভব করেন, তাহলে দেরি না করে একজন ভালো চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন। তিনি প্রয়োজনে কিছু টেস্ট বা স্ক্যান করতে বলবেন, যাতে আসল সমস্যা ধরা পড়ে এবং সময়মতো চিকিৎসা শুরু করা যায়।

নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ক্যান্সার স্ক্রিনিং, আর একটা স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন — যেমন সঠিক খাওয়াদাওয়া, ব্যায়াম, ধূমপান থেকে দূরে থাকা — এগুলো ক্যান্সার প্রতিরোধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপায়।

Also read: ওভারিয়ান ক্যান্সারের জন্য আপনার A-Z গাইড

Disclaimer:

This information on this article is not intended to be a substitute for professional medical advice, diagnosis, treatment, or standard medicines. All content on this site contained through this Website is for general information purposes only.