হাড়ের ক্যান্সার খুব একটা সাধারণ নয়, তবে হলে সেটা অনেক গুরুতর। এই রোগ তখন হয়, যখন হাড়ের ভেতরের কোষগুলো নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়তে শুরু করে। এই অস্বাভাবিক কোষগুলো সরাসরি হাড় থেকেই জন্মাতে পারে, আবার শরীরের অন্য কোথাও ক্যান্সার থাকলে সেখান থেকে ছড়িয়ে হাড়েও পৌঁছাতে পারে।
এই আলোচনায় আমরা ধাপে ধাপে জানব—হাড়ের ক্যান্সার ঠিক কী, কেন হয়, কী ধরনের হয়, কী কী লক্ষণ দেখা যায়, কেমনভাবে ধরা পড়ে, আর কীভাবে চিকিৎসা করা যায়।
হাড়ের ক্যান্সারের কারণ :
সব সময় হাড়ের ক্যান্সার ঠিক কী কারণে হয়, সেটা পরিষ্কার বোঝা যায় না। তবে কিছু বিষয় আছে যেগুলো থাকলে এই রোগের ঝুঁকি অনেকটাই বেড়ে যায়।
1. বংশগত প্রবণতা:
যাদের পরিবারে আগে থেকেই ক্যান্সারের ইতিহাস আছে, বা বিশেষ কিছু জেনেটিক রোগ যেমন লি-ফ্রোমেনি সিনড্রোম বা রেটিনোব্লাস্টোমা আছে, তাদের হাড়ের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। মানে, রোগটা রক্তের মধ্যে আগে থেকেই বহন করে আসছে।
2. রেডিয়েশন বা বিকিরণের প্রভাব:
যদি কেউ আগে কোনো কারণে অনেকটা রেডিয়েশন থেরাপি নিয়ে থাকেন, বা দীর্ঘ সময় ধরে শক্তিশালী রশ্মির সংস্পর্শে থাকেন (যেমন আয়নাইজিং রেডিয়েশন), তাহলে সেটাও হাড়ের কোষের ওপর প্রভাব ফেলে এবং ভবিষ্যতে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করে।
3. পেজেট রোগ:
এটা এক ধরনের হাড়ের অসুখ, যেখানে হাড় স্বাভাবিকভাবে বাড়ে না বা মেরামত হতে গিয়ে গোলমাল হয়। এই রোগ থাকলে অনেক সময় পরে ক্যান্সারের দিকে গড়াতে পারে।
4. জন্মগত বা বংশগত কিছু সমস্যা:
কিছু মানুষ জন্ম থেকেই কিছু হাড়ের গঠনগত সমস্যা নিয়ে জন্মায়, যেমন – একাধিক এক্সোস্টোস (হাড়ে বাড়তি গাঁট বা গুটি তৈরি হওয়া)। এগুলোর ক্ষেত্রেও ভবিষ্যতে ক্যান্সারের ঝুঁকি থেকে যায়।
হাড়ের ক্যান্সারের প্রকারভেদ :
হাড়ের ক্যান্সার সাধারণত দুই ধরনের হয় — একদিকে আছে প্রাথমিক হাড়ের ক্যান্সার, আর অন্যদিকে আছে সেকেন্ডারি বা ছড়িয়ে পড়া ক্যান্সার।
1. প্রাথমিক হাড়ের ক্যান্সার
এই ধরনের ক্যান্সার সরাসরি হাড় থেকেই শুরু হয়। এর মধ্যে কয়েকটা বিশেষ ধরণ দেখা যায়:
- অস্টিওসারকোমা:
এই ধরনের ক্যান্সার সাধারণত লম্বা হাড়ে (যেমন হাত বা পায়ের হাড়) হয়, এবং বেশিরভাগ সময় কিশোর-কিশোরীদের বা তরুণদের মধ্যে দেখা যায়। এটা খুব আক্রমণাত্মক ধরনের। - কনড্রোসারকোমা:
এটি তরুণাস্থি (হাড়ের সংযোগস্থলে থাকা নরম টিস্যু) থেকে শুরু হয়। বড়দের মধ্যে এই ক্যান্সার বেশি দেখা যায়, বিশেষ করে কোমর, নিতম্ব বা কাঁধের হাড়ে। - ইউইং সারকোমা:
এটি শিশুরা বা কিশোর-কিশোরীদের আক্রান্ত করে। এই ক্যান্সার সাধারণত লম্বা হাড়, পেলভিস বা মেরুদণ্ডে দেখা যায়।
2. সেকেন্ডারি বা মাধ্যমিক হাড়ের ক্যান্সার
এই ক্যান্সার আসলে শরীরের অন্য কোনো জায়গা যেমন স্তন, ফুসফুস বা প্রোস্টেট থেকে ছড়িয়ে এসে হাড়ে বাসা বাঁধে। একে বলে “মেটাস্টেটিক হাড়ের ক্যান্সার”। অর্থাৎ, হাড়ে শুরু হয়নি, কিন্তু ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ে এখানে এসে দাঁড়িয়েছে।
হাড়ের ক্যান্সারের লক্ষণ
হাড়ের ক্যান্সার হলে শরীরে কিছু বিশেষ ধরনের পরিবর্তন বা উপসর্গ দেখা যায়। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে এগুলো খুব সহজে বোঝা যায় না। ধীরে ধীরে কিছু লক্ষণ স্পষ্ট হতে শুরু করে:
1. হাড়ে ব্যথা:
সবচেয়ে সাধারণ উপসর্গ হলো হাড়ে ব্যথা। এই ব্যথা প্রথমে আসা-যাওয়া করে, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্থায়ী হয়। রাতে বা বিশ্রামের সময় ব্যথা বেশি হয়।
2. ফোলাভাব বা গাঁটে গাঁটে উঁচু ভাব:
যেখানে ক্যান্সার হয়েছে, সেখানে হাড়ের ওপর বা আশেপাশে ফোলা দেখা যায়। মাঝে মাঝে ওই জায়গা শক্ত বা উঁচু হয়ে যায়।
3. চলাফেরায় অসুবিধা:
যদি পা বা কোমরের হাড়ে ক্যান্সার হয়, তাহলে হাঁটা-চলার সময় কষ্ট হয় বা ল্যাংড়াতে দেখা যায়।
4. হাড় ভেঙে যাওয়া:
কখনো হাড় এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ে যে সামান্য ধাক্কা বা চাপেই ভেঙে যায়। এটা ক্যান্সারের কারণে হাড়ের ভেতর দুর্বলতা তৈরি হলে ঘটে।
5. ওজন কমে যাওয়া ও দুর্বলতা:
শরীর ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে, খাওয়া-দাওয়ায় অনীহা আসে এবং অকারণে ওজন কমতে থাকে।
6. জ্বর বা ক্লান্তি:
কখনো কখনো কম জ্বর বা সারাদিন ক্লান্তিভাবও দেখা যেতে পারে, যা সহজে বোঝা যায় না।
হাড়ের ক্যান্সার নির্ণয় :
যদি হাড়ের ক্যান্সার সন্দেহ করা হয়, তবে এর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে এবং এর বৈশিষ্ট্যগুলি নির্ধারণ করতে একাধিক ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা করা হবে:
ইমেজিং পরীক্ষা: এক্স-রে, সিটি স্ক্যান, এমআরআই এবং হাড়ের স্ক্যানগুলি হাড়গুলিকে কল্পনা করতে এবং অস্বাভাবিকতা সনাক্ত করতে সহায়তা করে।
বায়োপসি: একটি বায়োপসি একটি মাইক্রোস্কোপের নীচে পরীক্ষার জন্য সন্দেহভাজন টিউমার থেকে একটি ছোট টিস্যুর নমুনা নেওয়া জড়িত। এটি ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্য নির্দিষ্ট পদ্ধতি।
রক্ত পরীক্ষা: রক্তে কিছু পদার্থের উচ্চ মাত্রা হাড়ের ক্যান্সারের উপস্থিতি নির্দেশ করতে পারে।
চিকিৎসার বিকল্প
হাড়ের ক্যান্সার ধরা পড়লে, চিকিৎসা কতটা ছড়িয়েছে, ক্যান্সারটা কী ধরণের, রোগীর বয়স, ও শারীরিক অবস্থা — সব মিলিয়ে ঠিক করা হয় কোন চিকিৎসা হবে। চলুন দেখি কী কী চিকিৎসার বিকল্প আছে:
অপারেশন :
যদি ক্যান্সারটা হাড়ের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে সেটুকু হাড় কেটে ফেলে দেওয়া হয়। এখন অনেক উন্নত পদ্ধতিতে হাড় কেটে ফেলে দিয়েও কৃত্রিম হাড় বসিয়ে দেওয়া যায়, যাতে হাত-পা বা শরীরের অংশ কেটে ফেলতে না হয়।
কেমোথেরাপি:
এটি এক ধরনের ওষুধের চিকিৎসা যা রক্তের মাধ্যমে সারা শরীরে গিয়ে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করে। বিশেষ করে ইউইং সারকোমা বা ছড়িয়ে পড়া ক্যান্সারের ক্ষেত্রে কেমো অনেক কার্যকর।
রেডিওথেরাপি (রেডিয়েশন):
হাই পাওয়ারের রশ্মি ব্যবহার করে ক্যান্সার কোষ মেরে ফেলা হয়। যদি অপারেশন সম্ভব না হয়, বা অপারেশনের আগে/পরে ক্যান্সার কোষ কমাতে হয়, তখন এটি দেওয়া হয়।
টার্গেটেড থেরাপি ও ইমিউনোথেরাপি:
এই ধরনের চিকিৎসা এখন আধুনিক। কিছু নির্দিষ্ট ক্যান্সারের ক্ষেত্রে বিশেষ ওষুধ দিয়ে ক্যান্সার কোষকে লক্ষ্য করে মারা হয়। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে ক্যান্সার মোকাবিলা করানোর পদ্ধতিও এখন ব্যবহৃত হচ্ছে।
ক্লিনিকাল ট্রায়াল: ক্লিনিকাল ট্রায়ালগুলিতে অংশগ্রহণ কিছু রোগীদের জন্য একটি বিকল্প হতে পারে, যা উদ্ভাবনী চিকিত্সার অ্যাক্সেস প্রদান করে।
পূর্বাভাস এবং বেঁচে থাকার হার
“হাড়ের ক্যান্সার কতটা জটিল হবে বা একজন রোগী কতদিন সুস্থভাবে বাঁচতে পারবেন, সেটা নির্ভর করে ক্যান্সারের ধরন, সেটা কতটা ছড়িয়ে পড়েছে, আর রোগীর শরীরের সামগ্রিক অবস্থার ওপর। এখন চিকিৎসার অনেক উন্নতি হয়েছে, তাই হাড়ের ক্যান্সার হলেও অনেকেই দীর্ঘদিন ভালোভাবে বেঁচে থাকেন। তবে ভবিষ্যতে আবার ক্যান্সার ফিরে আসে কিনা, সেটা দেখার জন্য নিয়মিত ডাক্তারের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করানো খুবই জরুরি।”
হাড়ের ক্যান্সারের সাথে মোকাবিলা করা
হাড়ের ক্যান্সার ধরা পড়া মানসিক এবং শারীরিকভাবে অনেক চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। এই সময় স্বাস্থ্যকর্মী, বন্ধু-বান্ধব আর পরিবারের সমর্থন খুবই দরকার। তাছাড়া, সহায়তা গোষ্ঠীতে যোগ দেওয়া বা কাউন্সেলিং নেওয়া অনেকেই মানসিক চাপ কমাতে এবং ক্যান্সারের সঙ্গে জীবনযাপনের কঠিন দিকগুলো সামলাতে সাহায্য পায়।
উপসংহার
হাড়ের ক্যান্সার একটি জটিল ও বিরল রোগ, যা অনেক সময় সঠিকভাবে শনাক্ত ও চিকিৎসা করা কঠিন হয়ে পড়ে। এই রোগের কার্যকর ব্যবস্থাপনার জন্য বিভিন্ন বিভাগের বিশেষজ্ঞদের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন হয়। কারণ, শুধুমাত্র এক ধরনের চিকিৎসা দিয়ে এই রোগের মোকাবিলা সম্ভব নয়; বরং একাধিক পদ্ধতির মিশ্রণ এবং টিমওয়ার্কের মাধ্যমে রোগীর উন্নত ফলাফল আনা সম্ভব হয়।
হাড়ের ক্যান্সারের ঝুঁকির কারণ সম্পর্কে সচেতন থাকা খুবই জরুরি, কারণ সময়মতো প্রাথমিক সনাক্তকরণ না হলে রোগটি অনেক বেশি জটিল হয়ে যেতে পারে। আধুনিক চিকিৎসা ও প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে এখন অনেক উন্নত চিকিৎসার বিকল্প পাওয়া যাচ্ছে, যা রোগীদের জীবনমান উন্নত করতে সাহায্য করছে। গবেষকরা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন থেরাপি এবং চিকিৎসার পদ্ধতি নিয়ে কাজ করছেন, যা ভবিষ্যতে এই রোগের প্রতিরোধ এবং চিকিৎসাকে আরও সহজ ও কার্যকর করে তুলবে।
সংক্ষেপে বলা যায়, হাড়ের ক্যান্সার সম্পর্কে এর কারণ, প্রকার, উপসর্গ, রোগ নির্ণয় প্রক্রিয়া এবং চিকিৎসার বিভিন্ন বিকল্প সম্পর্কে গভীর জ্ঞান থাকা জরুরি। এই জ্ঞানের ভিত্তিতে রোগী ও চিকিৎসকরা একসঙ্গে কাজ করে এই ভয়ঙ্কর রোগের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে পারেন এবং রোগীর জীবনকে ভালো করার পথ খুলে দিতে পারেন। তাই সচেতনতা, সময়মতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং আধুনিক চিকিৎসার সুবিধা গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন, যাতে এই কঠিন রোগকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়।
Also Read: ট্যাটু এবং ক্যান্সার সম্পর্কে আপনার কি জানা উচিত?
Disclaimer:
This information on this article is not intended to be a substitute for professional medical advice, diagnosis, treatment, or standard medicines. All content on this site contained through this Website is for general information purposes only.